ব্যক্তিগত চিঠির সংকট কেড়ে নিচ্ছে পোস্ট অফিসগুলোর জৌলুস
জহির রায়হান প্রকাশিত: ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ , ২৮ জুলাই ২০১৯, রবিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 6 years আগে
আমরা স্বল্পোন্নত দেশ ছিলাম, আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি। বিশ্ব এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে। কৃষি, স্বাস্থ্য, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সেক্টরকে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি ডাক বিভাগে।
একসময় চিঠি নিয়ে এমন কত আবেগতাড়িত গান বাজতো বেতার-টিভিতে। এরও আগে যখন ডাকেরই প্রচলন হয়নি, তখন পোষা পায়রার পায়ে বেঁধে প্রিয়জনের কাছে বার্তা পাঠাতো মানুষ। এরপর উপমহাদেশের দিল্লির সম্রাট শের শাহ’র আমলে ঘোড়ার মাধ্যমে দ্রুতভাবে চিঠি পাঠানো হত। এছাড়াও উনবিংশ শতাব্দীর ও তার পরবর্তীতে রানারদের মাধ্যমে ডাক পাঠানো হত। এরপর প্রিয়জনের চিঠি পাবার আশায় ডাকপিয়নের পথ চেয়ে থাকার দিন হলো শুরু। সেই যুগ আর নেই। ব্যক্তিগত চিঠির সংকট কেড়ে নিয়েছে পোস্ট অফিসগুলোর জৌলুস। নেই মানুষের আনাগোনা, নেই কর্মচাঞ্চল্য; ক্রমেই তীব্র হচ্ছে অস্তিত্ব সংকট।
শহর পেরিয়ে এখন প্রত্যন্ত গ্রামের খেটেখাওয়া মানুষের হাতেও পৌঁছে গেছে প্রযুক্তি। যোগাযোগ রক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহারের এই বিস্তৃতিই ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে চিঠিকে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ই-মেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইমো, ভাইবারসহ কত প্রযুক্তির সুবিধা আজ সবার জন্য অবারিত। এখানটায় শহরের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই গ্রাম। গ্রামের মানুষের কাছেও এখন এসব সুবিধা পৌঁছে গেছে। যখন ইচ্ছে প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগটা তারাও নিচ্ছে। বার্তা আদান প্রদানে চিঠির বদলে সবার ভরসা এখন নতুন নতুন প্রযুক্তি। এখন শহর থেকে দেশের প্রত্যন্ত অজপাড়াগাঁয় পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট ও ই-মেইল সেবা। তাই ডাকঘরের মাধ্যমে মান্ধাতা যুগের চিঠি, টেলিগ্রাম সেবার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে।
সরেজমিনে বিভিন্ন উপজেলার গ্রামাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ ডাকঘর দিনের পর দিন বন্ধ থাকছে। অধিকাংশ ডাকঘরে নেই কোনো ডাক-বাক্স। দু-একটি থাকলেও তার মধ্যে চিঠির পরিবর্তে থাকছে বিড়ি, সিগারেটসহ ময়লা আবর্জনা। জেলা এবং উপজেলা ডাকঘর ছাড়া সব কটিতেই এই নাজুক অবস্থা। এক সময় ডাকঘরগুলো মুখরিত থাকতো রানার কিংবা ডাক পিয়নের পদচারণায়। মানুষ ডাকঘরের সামনে অপেক্ষা করতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ, কখন যে আসবে কাঙ্ক্ষিত সেই চিঠি। কিন্তু ডাক বিভাগের সেই ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে ।
রানার কিংবা ডাক পিয়নের কাঁধে এখন আর থাকে না খবরের বোঝা। কেউ আর অপেক্ষায় থাকে না প্রিয়জনের চিঠির। তবু গ্রাম-শহরে এখনো মাঝেমধ্যে দেখা মেলে পিয়নের। সুখ-দুঃখের কথামালার ব্যক্তিগত চিঠি নয়, রেজিস্ট্রি চিঠি কিংবা পার্সেল তুলে দেন প্রাপকের হাতে।
একজন ডাকপিয়ন বলেন, ‘আগে মানুষ রাস্তাঘাটে দেখলেই জিজ্ঞাসা করত পিয়ন ভাই চিঠি কি আছে? এখন আর কেউ এমন জিজ্ঞাসা করে না। শুধু চাকরির চিঠি আসে এখন।’
ডাক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সরকারি/বেসরকারি সব মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ডাকঘর রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ২৫ টি বাকি সবগুলো বেসরকারি। ডাক সরবরাহের জন্য জেলা সদর সহ বিভিন্ন উপজেলার পোস্ট অফিসগুলোতে কাজ করছেন প্রায় চারশত কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এর মধ্যে সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন একশো।
ডাকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি কোম্পানিগুলো চিঠি আদান-প্রদানে আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে এলেও ডাক বিভাগ এখনো পড়ে আছে আগের যুগে। আর এ কারণেই যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মানুষ আধুনিক কুরিয়ার সার্ভিসকে বেছে নিচ্ছে। এরপরও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ডাক বিভাগে নতুনভাবে যুক্ত হল নগদ। যার মাধ্যমে দ্রুত টাকা পাঠানো সম্ভব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পোস্ট অফিসের কর্মকর্তা পোস্ট মাষ্টার মো: গিয়াস উদ্দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাইমসকে বলেন, জেলা শহর থেকে গড়ে প্রতিদিন ২০/২৫ টি পার্সেল বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানো হয়। এর মধ্যে ব্যক্তিগত কোন চিঠি নেই, সবগুলোই সরকারি রেজিস্ট্রিকৃত ডাক। এরপরও লোকবল সংকটের কারণে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
ডাক বিভাগের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চিঠি, রেজিস্ট্রি, পার্সেল এর ক্ষেত্রে আরো ডিজিটালাইজ করলে ডাক বিভাগের গুরুত্ব বাড়বে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। পাশাপাশি দক্ষ জনবল নিয়োগসহ যে পোস্ট অফিসগুলোর সামনে ডাকবাক্স নেই সেখানে নতুন ডাকবাক্স প্রতিস্থাপন করার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
সুশীল সমাজ মনে করেন, জীবনমান প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগের বিষয়টিতে নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে। তাদের মতে, শুধু আবেগ, অনুভূতি আর ভালোবাসা নয়, চিঠির সাথে জড়িয়ে আছে সভ্য সমাজ বিনির্মাণের ইতিহাসও। হয়তো ডাক পিয়নের হাতে চিঠি আসার দিন আর ফিরবে না কখনো। তবু পুরনো চিঠি ও চিঠি সংক্রান্ত সাহিত্যকর্মের মাধ্যমেই মানুষের হৃদয়ে বহুদিন বেঁচে থাকবে যোগাযোগের ঐতিহ্যবাহী এই মাধ্যমটির নাম।
আপনার মন্তব্য লিখুন