আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস আজ
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ৪:০৬ অপরাহ্ণ , ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 years আগে
সাক্ষরতা শিখন ও দক্ষতা উন্নয়নের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টির জন্য সমন্বিত সাক্ষরতা কার্যক্রমের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ৫০-এর দশক থেকে সমন্বিত সাক্ষরতার ধারণা ইউনেস্কোর একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। এতে সাক্ষরতা বলতে বোঝাত ‘পড়তে, লিখতে ও গণনা করতে পারা।’
জহির রায়হান : আজ ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ‘প্রত্যেক মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে’ জাতিসংঘের এ ঘোষণাকে সামনে রেখে আজ থেকে ৫০ বছর আগে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে গেল ৬ দশক ধরে দিবসটি সারা পৃথিবীতে পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরই এ দিবসের একটি স্লোগান থাকে, সেই স্লোগানের মূল ভাবকে কেন্দ্র করে শিক্ষার আলো কিছুটা বিস্তৃত হয়। ২০১৮ সালের সাক্ষরতা দিবসের স্লোগান হলো ‘সাক্ষরতা ও দক্ষতা উন্নয়ন’। বর্তমান শতাব্দীর নতুন প্রজন্ম প্রবেশ করেছে দ্রুত পরিবর্তনশীল এক নতুন পৃথিবীতে। বিজ্ঞান, টেকনোলজি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলাই আজকের সাক্ষরতা। আর এ জন্য প্রয়োজন যথাযথ দক্ষতা। কারণ সাক্ষরতা প্রয়োগে দক্ষতার প্রয়োজন। আর এ জন্যই এবারের স্লোগান সাক্ষরতা ও দক্ষতা উন্নয়ন। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর মানুষকে শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করা। যেন সব মানুষ বর্তমানের জন্য প্রযোজ্য শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এবারের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের উদ্দেশ্য হলো যুব ও বয়স্কদের জন্য জীবনব্যাপী শিখন কাঠামোর আওতায় এবং সাক্ষরতা ও দক্ষতার মধ্যে কার্যকর যোগসূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে সাক্ষরতা ও দক্ষতা উন্নয়ন করা। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০১৮-তে দক্ষতা বলতে বোঝাবে কর্মযোগ্যতা, জীবন বিকাশ ও জীবন দক্ষতার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও ভোকেশনাল যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা বিনিময় ও ডিজিটাল দক্ষতা।
সাক্ষরতা শিখন ও দক্ষতা উন্নয়নের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টির জন্য সমন্বিত সাক্ষরতা কার্যক্রমের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ৫০-এর দশক থেকে সমন্বিত সাক্ষরতার ধারণা ইউনেস্কোর একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। এতে সাক্ষরতা বলতে বোঝাত ‘পড়তে, লিখতে ও গণনা করতে পারা।’ সারা পৃথিবীতে এখনও অসংখ্য মানুষ আছে, যারা পড়তে, লিখতে পারে না, নিরক্ষরতার অভিশাপ নিয়ে তারা অভিশপ্ত জীবনযাপন করছে। কিন্তু নিরক্ষরতার এ অভিশাপ দূর হওয়ার আগেই পৃথিবীতে চলে এসেছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, যা মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে ব্যাপকভাবে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাবে সমাজ, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ সবকিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক যোগাযোগ, বিনোদন প্রতিটি ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করেছে। একসময় ছেলেমেয়েরা শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পছন্দ করত। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি বিস্তারের কারণে এখন শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয় হলো কম্পিউটার সায়েন্স, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি কম্পিউটারবিষয়ক বিষয়। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে চিকিৎসাক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া বর্তমানে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা একেবারেই অসাধ্য। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে প্রাগৈতিহাসিক হালের বলদের চাষাবাদ কৃষি যন্ত্রপাতির চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রায়। সামাজিক যোগাযোগ এখন ফেইসবুকের মাধ্যমে ম্যানিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ সামনাসামনি কথা বলার পরিবর্তে এখন ফেইসবুকে যোগাযোগ করাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
প্রচলিত ধারণায় সাক্ষরতা হলো মানুষের অক্ষর জ্ঞান। যার অক্ষর জ্ঞান আছে সে-ই সাক্ষর। অক্ষর হলো জ্ঞানের আলো। তাই যে যত বেশি অক্ষর জানে, সে তত বেশি জ্ঞানের অধিকারী। এটিই প্রচলিত ধারণা। সে জন্য জন্মের পর সব শিশুকে বেশি করে অক্ষর শেখানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। অক্ষর শিখতে শিখতেই মানুষ শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে। শিক্ষা হলো মানুষের আচরণের ইতিবাচক পরিরর্তন। শিক্ষার তিনটি ডোমেন আছে। এগুলো হলোÑ জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণ। মানুষ নানাভাবে জ্ঞান অর্জন করে। তারপর সেই জ্ঞান প্রয়োগ করে দক্ষতা অর্জন করে। আর এ সার্বিক অর্জনের মধ্য দিয়ে তার আচরণিক পরিবর্তন সাধিত হয়। তবে এ আচরণিক পরিবর্তনই শিক্ষার মূল। কারণ আচরণ ইতিবাচক হতে পারে আবার নেতিবাচকও হতে পারে। আচরণের যদি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে তবে শিক্ষা সার্থক হয়েছে বলা যায়। কারণ এ শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা এবং এই শিক্ষা মানবসমাজের প্রভূত উপকারে কাজে লাগে। তবে আচরণের নেতিবাচক পরিবর্তন সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলে। সুতরাং সাক্ষরতার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য।
বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকা, কাজ করা, শিক্ষা দেওয়া-নেওয়া কিংবা সামাজিক হওয়ার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এখন মানুষ ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি ছাড়া চলতেই পারে না। তথ্যপ্রযুক্তির এ রূপান্তর ও বিস্তার এতই দ্রুতগতিতে ঘটেছে যে, মানুষ তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারেনি। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার ছাড়া আজকের পৃথিবী বলতে গেলে একেবারে অচল। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট কারও থাকুক বা না থাকুক এগুলো এখন নিত্যপ্রয়োজনীয়। তাই এসব ব্যবহারের দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার সময় এসেছে। কারণ শুধু সাক্ষরতার জ্ঞান দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় না। আর এ দক্ষতা উন্নয়ন প্রক্রিয়া সাময়িক নয়। প্রতিনিয়ত অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগের জন্য দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে দক্ষতা উন্নয়নের প্রক্রিয়া জীবনব্যাপী সাক্ষরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি পলিসি এবং জাতীয় শিক্ষানীতিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনে তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মহাপরিকল্পনা (২০১২-২০২১)-এ ২০১৮ সালের মধ্যে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তি ল্যাব স্থাপনসহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি ক্লাসরুমকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে রূপান্তর করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে এরই মধ্যে সারা দেশে ৩৫ হাজারেও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন শুরু হয়েছে বলা যায়।
বাংলাদেশের দক্ষতা উন্নয়ন কৌশলের ক্ষেত্রে কার্যকর দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে ২০১১ সালে একটি জাতীয় দক্ষতা নীতি প্রণয়ন করা হয়। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক নীতিসংক্রান্ত অন্যান্য জাতীয় নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে আশা করা হয়, যাতে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মধ্যম আয়ের একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। জাতীয় দক্ষতা নীতির উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়ন সংস্কার কার্যক্রমের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রদান; বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নের মান এবং প্রাসঙ্গিকতার উন্নয়ন; আরও বেশি নমনীয় এবং দায়িত্বশীল সেবাদান কৌশল প্রতিষ্ঠা করা, যা শ্রমবাজার, ব্যক্তি এবং বৃহত্তর অর্থে সমাজের চাহিদা মেটাতে সক্ষম; নারীরও বিশেষ চাহিদা রয়েছে, এমন শ্রেণির মানুষসহ বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ আরও ব্যাপক করা; শিল্প সংগঠন, নিয়োগকারী এবং কর্মী বাহিনীর দক্ষতা উন্নয়নে অংশগ্রহণ এবং জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করা; বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দাতা সংস্থা, শিল্প এবং সরকারি ও বেসরকারি দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যাবলির ফলপ্রসূ পরিকল্পনা, সমন্বয় ও পরিবীক্ষণ আরও শক্তিশালী করা।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালার উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী হলো বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে জাতীয়ভাবে চিহ্নিত এমন জনগোষ্ঠী, যেমন যুব সম্প্রদায়, নারী, স্বল্পদক্ষতা সম্পন্ন মানুষ, বিশেষ চাহিদা রয়েছে এমন শ্রেণির মানুষ, অভিবাসী, দেশের ভেতর স্থানচ্যুত মানুষ, বয়স্ক শ্রমিক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বিভিন্ন সংস্কৃতির সংখ্যালঘু শ্রেণি এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসহ সব নাগরিকের এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকৃতির শিল্প, উপানুষ্ঠানিক অর্থনীতি, পল্লী খাত ও আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে।
জাতীয় দক্ষতা নীতিমালার আওতায় সরকার জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণাকে আরও বেশি সমন্বিত করার মাধ্যমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা শুরু করে এর পরিচালনা এবং উৎকর্ষ সাধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। শিক্ষার জন্য সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো কাজ পাওয়ার আগের প্রশিক্ষণ এবং বেকারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
সাক্ষরতার সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়নের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। শুধু সাক্ষরতা অর্জন করলেই জীবনমানের পরিবর্তন হয়ে যায় তেমনটা কিন্তু নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজন যথাযথ দক্ষতা উন্নয়ন, যা জীবনের গতি বাড়িয়ে দেয়। বর্তমান সময়ে সাক্ষরতা শুধুই অক্ষরজ্ঞান নয়, সাক্ষরতার সঙ্গে দক্ষতার উন্নয়নের ফলে সাক্ষরতার অর্থ বিস্তৃত হয়েছে। সেজন্য সাক্ষর জনগোষ্ঠী মানে শক্তি, যা দেশের উন্নয়নে সহায়তা করে।
আপনার মন্তব্য লিখুন