কয়লা খনি দুর্নীতির প্রমাণ দুদকের হাতে
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ৩:৩৩ পূর্বাহ্ণ , ২৭ আগস্ট ২০১৮, সোমবার , পোষ্ট করা হয়েছে 7 years আগে
নিজস্ব প্রতিবেদক : বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে অবৈধভাবে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ টন কয়লা বিক্রি করে ২২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। কয়লার মোট উত্তোলন, স্থিতি, মজুদ, বিক্রি ও নিজস্ব ব্যবহারের হিসাব যাচাই করে আত্মসাতের হিসাব নির্ণয় করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, ওই হিসাব ও তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) দায়ের করা মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হচ্ছে।
গত ১৩ আগস্ট দুদক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি সদর দপ্তরে সরেজমিন তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগির এই মামলার চার্জশিট আদালতে পেশ করা হবে।
দুদক উপপরিচালক মো. সামছুল আলম অভিযোগটি তদন্ত করছেন। তিনি এরই মধ্যে খনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২০০১ সাল থেকে চলতি বছরের ২৪ জুলাই পর্যন্ত ১৭ বছর সাত মাসের প্রয়োজনীয় নথিপত্র জব্দ করেছেন। বিসিএমসিএলের একাধিক সাবেক এমডিসহ ২১ জন কর্মকর্তার বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তিন থেকে চারজন সাবেক এমডিসহ ৮-১০ জন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
দুদকের তদন্তে ২০০৪ সালের জুন থেকে গত ১৯ জুলাই পর্যন্ত খনিতে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ টন কয়লার মজুদ পাওয়া গেছে। সরেজমিন তদন্তে গত ২৪ জুলাই পর্যন্ত প্রকৃত মজুদ পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৯১৬ টন। এই হিসাব অনুযায়ী ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ টন।
প্রতি টন কয়লার দাম ১৫ হাজার ৯০১ দশমিক ১০ টাকা হিসাবে ঘাটতি ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ টন কয়লার দাম দাঁড়ায় ২২৮ কোটি ৫৪ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৩ টাকা।
২৩০ কোটি টাকা দামের ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন কয়লা ঘাটতির অভিযোগে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির প্রশাসন বিভাগ থেকে সম্প্রতি ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এদিকে দুদকের তদন্তে ২২৮ কোটি ৫৪ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৩ টাকা দামের ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ টন কয়লা বেআইনিভাবে খোলা বাজারে বিক্রি করে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধনের প্রমাণ মিলেছে।
দুদকের তদন্ত থেকে জানা গেছে, ২০০৪ সালের জুন থেকে চলতি বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত খনি থেকে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২ দশমিক ৩৩ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিডিবির কাছে ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯ টন ও বাইরে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০ টন। একই সময়ে নিজস্ব প্রয়োজনে খনির বয়লারে ব্যবহার করা হয় ১২ হাজার ৮৮ টন।
মোট উত্তোলন থেকে এই তিনটি পর্যায়ের হিসাব বাদ দেওয়া হলে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ টনের মজুদ স্থিতি পাওয়া যায়। খনি কর্তৃপক্ষের এই স্থিতির হিসাব থেকে উধাও হওয়া কয়লার পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে।
সম্প্রতি খনির ১ লাখ ১৬ হাজার টন কয়লা খোলা বাজারে বিক্রি করে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা আত্মসাতের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সেটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
এই অনুসন্ধান শেষ না হতেই ২৩০ কোটি টাকা দামের ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন কয়লা ঘাটতির অভিযোগ আনা হয়। এ ঘটনায় ২৪ জুলাই বিসিএমসিএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বাদী হয়ে সাবেক এমডি হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ সংশ্নিষ্ট ১৯ জনকে আসামি করে দিনাজপুরের পার্বতীপুর থানায় মামলা করেন।
সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রকৃত অপরাধকে আড়াল করতে দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে তড়িঘড়ি করে কয়লা ঘাটতির অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অনুসন্ধানকালে দুর্নীতির নথিপত্র, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত ও মামলার আসামি করা হতো। মামলার আগে বা পরে অভিযুক্তদের প্রয়োজনে গ্রেফতার করা হতো। কিন্তু বিসিএমসিএল মামলা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল ও গ্রেফতার এড়াতে চেয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তবে শেষ বিচারে প্রকৃত অপরাধীরা পার পাবে না।
বিসিএমসিএল থেকে মামলাটি করা হলেও ওই অপরাধ দুদকের তফসিলভুক্ত। এ কারণে অভিযোগ তদন্তের জন্য পার্বতীপুর থানা থেকে গত ২৬ জুলাই মামলার কপি প্রথমে পাঠানো হয় দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে। পরে দিনাজপুরের অফিস থেকে সেটি ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এরপর কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুরু হয় মামলার তদন্ত।
বিসিএমসিএলের সংশ্নিষ্ট অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কয়লা বিক্রি করে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ ছাড়াও অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেলে ওইসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা করা হবে।
জানা গেছে, দুদক ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় নথি জব্দ করেছে। এর মধ্যে ২০০১ সালের শুরুতে সাবেক বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় ছিল। পরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আলোচিত ওয়ান ইলেভেন আসে। ২০০৭-২০০৮ সাল পর্যন্ত সেনা সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তাই এ পর্যন্ত সব সরকারের আমলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অপরাধ সংশ্নিষ্টতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আপনার মন্তব্য লিখুন