২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

EN

সরাইলে শেখ হাসিনার উপহার পাকা ঘর বিক্রির অভিযোগ।।

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ১০:৫৬ অপরাহ্ণ , ৯ মে ২০২১, রবিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 3 years আগে

মো. তাসলিম উদ্দিন সরাইল( ব্রাহ্মণবিড়িয়া) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইলে শেখ হাসিনার উপহার পাকা ঘর বিক্রির অবিযোগ পাওয়া গেছে।
মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় প্রথম ধাপে ১০২ পরিবার প্রত্যেকে পেলো দুই শতক জমিসহ পাকা ঘর। এরমধ্যে উপজেলার শাহাজাদাপুর এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুই শতক জমিসহ ৯০নম্বর ঘরটির বরাদ্দ পান আব্দুল হাশিম মিয়া নামে এক ব্যক্তি। আব্দুল হাশিম ও তার স্ত্রী সেলিনা বেগমের নামে যৌথ দলিলও সম্পাদনা করেছে উপজেলা ভূমি অফিস। আব্দুল হাশিম মিয়া উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের রাণীদিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা মিয়ার ছেলে।
তবে আশ্রয় প্রকল্পে এই ঘর ও জায়গা বরাদ্দ, দলিল সম্পাদনা কোনকিছুরই ব্যাপারে জানেন না আব্দুল হাশিম মিয়া। সুযোগে এই ঘর ও জমি দুই লক্ষ টাকা রফাদফায় বিধবা সাফিয়া বেগম ও তার স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে রুনা বেগমের কাছে বেচে দেন উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়ন তেলিকান্দি ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ ও শাহাজাদাপুর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা হারুন মিয়া। প্রথমে অনুমান মাসখানেক আগে ঘর ও জমির বায়না বাবদ ১ লক্ষ টাকা গ্রহণ করেন ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ। পরে গত সপ্তাহে শাহজাদাপুর এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে ঘরের দখল বুঝিয়ে দিয়ে ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ ও হারুন মিয়া নেন ৫০ হাজার টাকা। চুক্তির বাকি ৫০ হাজার টাকা তাদেরকে দেয়ার কথা ছিল গত ৬ মে বৃহস্পতিবার। সেদিন এই ঘরের প্রকৃত মালিক আব্দুল হাশিম মিয়ার নামের দলিল পরিবর্তন করে সাফিয়া বেগম ও তার মেয়ের নামে নতুনভাবে মালিকানা দলিল দিতে না পারায় বাকি ৫০ হাজার টাকা তাদেরকে দেয়া হয়নি। এতে ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী এই দুই কর্মকর্তা এবং ক্রেতা সাফিয়া বেগম ও তার মেয়ে রুনা বেগমের মধ্যে বাকবিতন্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে বিষয়টি চাউর হয় উপজেলার বিভিন্ন মহলে। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

আজ শনিবার (৮ মে) বিকেলে ভুক্তভোগী মা ও মেয়ে দেড় লক্ষ টাকা ফেরত পেতে ও অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে তারা যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সেইসময়ে ইউএনও’র দফতরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা প্রিয়াংকাও উপস্থিত ছিলেন। উপজেলা প্রশাসনের এই দুই কর্মকর্তা ভুক্তভোগী মা ও মেয়ের সকল অভিযোগ শুনেন। এসময় ইউএনও’র দফতরে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সহিদ খালিদ জামিল খান ও স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।

উপজেলা সদরের হাবলীপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুর রশিদের স্ত্রী ভুক্তভোগী সাফিয়া বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আমি একজন হতদরিদ্র ও ভূমিহীন। ভূমি অফিসার আব্দুল কুদ্দুছ আমাদের কাছে শাহাজাদাপুর এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর দুই শতক জায়গাসহ দুই লক্ষ টাকায় বিক্রি করেছেন। তিনি বলেছিলেন এই ঘর যিনি পেয়েছেন আব্দুল হাশিম অরুয়াইলের রাণীদিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি শাহাজাদাপুর এলাকায় এতো দূরে বসবাস করতে আসবেন না। তাই ঘর-জমি অন্তত ১০ লক্ষ টাকার সম্পদ মাত্র দুই লক্ষ টাকায় তিনি আমাদের দয়া করে দিচ্ছেন। দলিলে আব্দুল হাশিম মিয়ার ছবি কেটে ও নাম পরিবর্তন করে সেখানে আমার ছবি ও নাম বসিয়ে নতুনভাবে দলিল সম্পাদনা করে দেবেন। তার কথা বিশ্বাস করে অনুমান একমাস আগে আমার মেয়ে রুনা বেগমের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা নিয়ে ভূমি অফিসার কুদ্দুছকে দেই।

সাফিয়া বেগম আরও বলেন, গত সপ্তাহে ভূমি অফিসার কুদ্দুছ আমাকে ও আমার মেয়ে রুনাকে নিয়ে শাহজাদাপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে যান। সেইসময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন শাহজাদাপুর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা হারুন মিয়া ও শাহজাদাপুর গ্রামের মেম্বার আজাহার মিয়া। তারা উপস্থিত থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৯০নম্বর ঘরটির দখল বুঝিয়ে দিয়ে চাবি আমাদের হাতে তুলে দেন। গ্রামের মেম্বার চলে গেলে ভূমি অফিসার কুদ্দুছ ও হারুন মিয়া আরও ৫০ হাজার টাকা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে দ্রুত চলে আসেন। আসার সময়ে চুক্তির বাকি ৫০ হাজার টাকা ৬মে বৃহস্পতিবার তাদের হাতে পৌঁছাতে আমাদের জানিয়ে দিয়ে আসেন। পরে শাহাজাদাপুর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা হারুন মিয়া আমার মেয়ের ফোনে কল দিয়ে জানান, ‘ইউএনও এবং পিআইও স্যার যদি সেখানে আশ্রয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে যান; তাহলে যেন বলি ‘আমি (সাফিয়া) আব্দুল হাশিম মিয়ার স্ত্রী এবং রুনা হাশিম মিয়ার মেয়ে।’ বিষয়টি জেনে আমরা হতবাক হই। নগদ টাকায় ঘর জমি কিনে মিথ্যা পরিচয় দেব কেন?

সাফিয়া বেগমের মেয়ে রুনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আমার স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে আমাকে তালাক দেন বছরখানেক আগে। আমি এসিল্যান্ড ম্যাডামের বাসায় মাঝেমধ্যে ‘ঝি’-এর কাজ করতাম। উপজেলা চেয়ারম্যান, এসিল্যান্ড ম্যাডাম ও সদর ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় আমি দেনমোহর ও খোরপোষ বাবদ ৩ লক্ষ টাকা আদায় করি স্বামীর কাছ থেকে। বিষয়টি সদর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আশেক এলাহি জানতেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও জায়গা কেনার পথ আশেক এলাহি দেখিয়ে দিয়ে ভূমি অফিসার আব্দুল কুদ্দুছের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। তেলিকান্দি ভূমি অফিসের উপসহকারী কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ ও শাহাজাদাপুর ভূমি অফিসের উপসহকারী কর্মকর্তা হারুন মিয়া দু’জনে মিলে আমাদের কাছ থেকে দুই দফা দেড় লক্ষ টাকা নিয়েছেন। আমার দেনমোহরের টাকা থেকে এই টাকা দিয়েছি। আমার একমাত্র অবুঝ কন্যা সন্তানের ভবিষ্যৎ এই টাকা; ভেবেছিলাম বৃদ্ধ মা ও আমার একটা স্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে। এখন দেখতেছি এই তিন ভূমি অফিসার আমাদের সঙ্গে প্রতারণা জালিয়াতি করেছেন।

রুনা বেগম আরও বলেন, গত ৬ মে চুক্তির বাকি ৫০ হাজার টাকা নিতে চাইলে আমরা ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ-এর কাছে ঘর ও জমির দলিল চায়; নতুবা আর টাকা দেবো না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আব্দুল কুদ্দুছ জানান, উপজেলার বর্তমান ইউএনও এবং এসিল্যান্ড বদলি না হওয়া পর্যন্ত এই দলিল পরিবর্তন সম্ভব নয়; এক্ষেত্রে একবছর সময়ও লাগতে পারে! একথা শুনে আমাদের দেওয়া দেড় লক্ষ টাকা ফেরত চায়। এরপর থেকে আব্দুল কুদ্দুছ আমাদের ফোন নাম্বার ব্লক মেরে রেখেছেন। হারুন মিয়া এখন উল্টাপাল্টা কথা বলছেন।

শনিবার বিকেলে ইউএনও স্যারের কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে তিনি জানান, ‘কেন এ বিষয়টি সাংবাদিকদের জানালাম।’ অপরদিকে ‘ইউএনও স্যারের সামনেই এসিল্যান্ড ম্যাডাম আমাকে গালমন্দ করেছেন। কেন দেড় লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছি; এ অপরাধে আমাকে ও আমার মাকে জেল হাজতে পাঠাবে বলে শাসিয়েছেন তিনি। রোজার আগে আমাকে এসিল্যান্ড ম্যাডামের বাড়িতে ঢাকায় কাজে যাওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ আমার বৃদ্ধ মা উঠানে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যাথা পান; এতে আমি ঢাকায় উনার বাড়িতে কাজে যেতে পারিনি। এতে এসিল্যান্ড ম্যাডাম আমার ওপর চরম ক্ষেপে আছেন। এখন কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা। ন্যায় বিচার ও দেড় লক্ষ টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে আবার কোনো বিপদে পড়তে হয় কিনা; এ আতঙ্কে আছি। এমন দাবি, ভুক্তভোগী সাফিয়া বেগম ও তার মেয়ে রুনা বেগমের।

এদিকে শনিবার বিকেলে শাহাজাদাপুর এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৯০ নম্বর ঘরের দলিলের প্রকৃত মালিক অরুয়াইলের রাণীদিয়া গ্রামের আব্দুল হাশিম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ প্রতিবেদক’কে বলেন, আল্লাহ আমাকে সহায়-সম্পত্তি কম দেয়নি। আমি সরকারি ঘর চাইতে যাবো কেন? এলাকায় আমার একটা মর্যাদা আছে। আমার এক ছেলে রাসেল মাহমুদ জেলার নবীনগর উপজেলার লাউর ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব পদে চাকুরি করছেন। কয়েকমাস আগে বাড়ির পাশের একটি খাস জমি লীজ-বন্দোবস্ত আনতে আমার ছবি, ভোটার কার্ড ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমার এই ছেলে নিয়ে গিয়ে কুদ্দুছ-এর কাছে দিয়েছিল। শুনেছি ভূমি অফিসের কুদ্দুছ ও আমার সচিব ছেলে দু’জনে মিলে আমার নামে সরকারি ঘর বরাদ্দ এনেছেন। আমি দলিল করতেও যাইনি, এই ঘর-জমি নেওয়া প্রশ্নই উঠে না। আমার ছেলে ও কুদ্দুছ তাদের কি প্রয়োজনে এই সরকারি ঘর-বাড়ি আমার নামে বরাদ্দ করিয়াছে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।

এ বিষয়ে পাকশিমুল (তেলিকান্দি) ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, সাফিয়া বেগম ও তার মেয়ে রুনা বেগম আমার কাছে সরকারি ঘর চেয়েছিলেন। তবে আমি তাদের কাছ থেকে কোন টাকাপয়সা নেইনি। তারা মিথ্যা কথা বলছেন। তাছাড়া রুনা মেয়েটার স্বভাব চরিত্র তেমন ভালো না। আমি তাদেরকে শাহাজাদাপুর এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিয়ে গিয়েছিলাম হারুন মিয়ার কথায়। রুনা বেগম ও তার মা সেখানকার আশ্রয়ণ প্রকল্প চেনেন না। এই জন্য তাদের পথ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাদের পেছনে আমার দেড়শ টাকাও খরচ হয়; তাদেরকে সেখানে রেখে সঙ্গে সঙ্গে আমি চলে আসি।

শাহাজাদাপুর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা হারুন মিয়া বলেন, সাফিয়া বেগম ও রুনা বেগম এখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকতে পারবেন অরিজিনাল মালিক আব্দুল হাশিম মিয়ার ওয়ারিশ পরিচয়ে। কিন্তু তারা মা ও মেয়ে তাদের নামের দলিল চান। তাই এ বিষয়ে তেলিকান্দি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছের সঙ্গে মা ও মেয়েকে কথা বলতে জানিয়ে দিয়েছি। তাদের কাছ থেকে আমি একটি টাকাও নেইনি। তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ভিত্তিহীন।

এ ব্যাপারে সরাইল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা প্রিয়াংকা গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল হক মৃদুল গণমাধ্যমকে জানান, ভুক্তভোগী মা ও মেয়ে আমার দফতরে এসে এ ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদেরকে আগামীকাল (আজ রোববার) সকালে আমার দফতরে হাজির হতে বলেছি। সেইসময়ে অভিযোগকারী মা ও মেয়েকেও থাকতে বলেছি। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে অবশ্যই দেখবো।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

May 2021
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  
আরও পড়ুন