১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

EN

নামেই সামাজিক সংগঠন ; উদ্দেশ্য প্রতারণার মাধ্যমে নিরীহ শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাৎ

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ১০:৩৬ অপরাহ্ণ , ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 6 years আগে

জহির রায়হান, লেবানন থেকে : লেবাননে ব্যাঙের ছাতার মত রাতারাতি গজিয়ে উঠছে অসংখ্য ‘সামাজিক সংগঠন’, উদ্দেশ্য প্রতারণার মাধ্যমে নিরীহ শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাৎ। একটি বাহারী সাইনবোর্ড এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার চাইতে ভাল বাচনভঙ্গি সম্পন্ন যোগ্যতাকে প্রধান্য দিয়ে কিছু সদস্য যোগাড় করে আভির্ভাব ঘটছে এই সমস্ত সংগঠনগুলোর। সেইসাথে ‘সামাজিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনের নামে নানান অজুহাতে অর্থ আত্মসাৎ বেড়েছে, দমন করবে কে?’

এক.
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে লেবানন অতুলনীয়। লেবাননকে ছয়টি প্রশাসনিক এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো বৈরুত, নেবাতিহ, বেকা, উত্তর প্রশাসনিক এলাকা, মাউন্ট লেবানন এবং দক্ষিণ প্রশাসনিক এলাকা। প্রত্যেকটি প্রশাসনিক এলাকা কয়েকটি শহর বা গ্রাম নিয়ে গঠিত। তবে বৈরুত প্রশাসনিক এলাকাতে বৈরুত ছাড়া অন্য কোনো শহর বা গ্রাম নেই।

বৈরুত – এই শহরটি লেবাননের রাজধানী। এটি একটি বানিজ্যিক শহর, অন্য বিভিন্ন কারণেও বেশ পরিচিত। আশির দশকের দিকে জর্ডান হয়ে সিরিয়া বর্ডার ক্রসকরে এই শহরে প্রথম কোন বাংলাদেশী প্রবেশ করেন বলে জানা যায়। এরপর ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে আরো অল্পসংখ্যক বাংলাদেশী এ শহরে আসেন এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে অনেকেই এখানে আসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই শহরে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অনেকেই আবার দেশ থেকে তাদের ভাই অথবা আত্মীয় স্বজন নিয়ে আসেন। এই শহরে সবাইকেই নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। এই সব সমস্যা সমাধানে এবং সবাই মিলেমিশে প্রবাসের মাটিতে একটি ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশী কমিউনিটি গড়ার লক্ষ্যে একটি সামাজিক সংগঠনের জন্ম হয়, যার নাম “বাংলাদেশ বৈরুত এসোসিয়েশন।”

প্রবাসী কমিউনিটির এই একটি সামাজিক সংগঠন থেকেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে বিভিন্ন সেবা প্রদানের মাধ্যমে সকলের হৃদয়ে জায়গা করে নেয় এবং বেশ প্রশংসিত হয়। সব মিলিয়ে বেশ ভালই চলছিল সংগঠনটি। তবে ২০১৩ সালে পদ পদবী এবং নিজস্ব কোন্দলে সংগঠনটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বিভিন্নভাবে শুরু করেন লেবাননে বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম। এরই মধ্যে লেবাননের মাটিতে জন্ম নেয় প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেক নতুন সংগঠন।

দুই.
লেবাননে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি বাংলাদেশীর বসবাস। অন্যান্য যে কোন দেশী অভিবাসীর তুলনায় এই দেশে বাংলাদেশীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও নারী-পুরুষের অবাদ মেলামেশা এবং নিজেদের মধ্যে সব থেকে বেশি দ্বন্দ্ব – বিভেদের কারণে সবার কাছে বেশ পরিচিত। বিগত কয়েক বছরে এখানে বিভিন্ন নামে, নানান উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হয়েছে এবং আর্থিক লেনদেন ও সদস্যদের মাসিক চাঁদার টাকা আত্মসাতের কারণে বেশকিছু সংগঠন নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। বর্তমানে লেবাননে আনুমানিক প্রায় ২০-২৫টি রাজনৈতিক ও বিভিন্ন নামের সামাজিক সংগঠন আছে, যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

তবে অবাক করার মত বিষয় হল, এই সংগঠনগুলোর প্রায় সবই দুই ভাগে বিভক্ত। একটি সংগঠন করতে গিয়ে দেখা যায় সেখান থেকে ভেঙ্গে আরো দুটি সংগঠন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে বাংলাদেশ “বাংলাদেশ বৈরুত এসোসিয়েশন” নামে একটি সামাজিক সংগঠনের নাম শোনা যেতো, এখন সেখানে বিভাগ, জেলা, থানা, ইউনিয়ন এমনকি কয়দিন পর হয়তোবা কারো নামেই একটি সংগঠন দেখা যাবে।

একটি সংগঠনের জন্ম হয় তার নির্ধারিত কিছু লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং বিশেষ প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভর করে। কিন্তু লেবাননের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে যে কোন সময় যে কোন কারণে-অকারণে সংগঠন জন্ম নেয়। প্রতিটি সংগঠনেরই উদয় হয় আর্থ সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজ দিয়ে এবং অসহায় প্রবাসীদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে। অন্তত এই সব কথা তাদের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদকদের লম্বা ভাষণে বেশ ভালভাবেই শোনা যায়, যখন নতুন কোন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এই সংগঠনগুলোর আত্মপ্রকাশের কিছুদিন পর দেখা যায়, দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একই মানুষ যারা সমাজের অসহায় মানুষদের কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তারাই নিজ নিজ স্বার্থে ভাগ হয়ে আরেকটি সংগঠনের জন্ম দিচ্ছেন। যা শুধু লেবাননে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছড়ানো ছাড়া অন্য কোন ভূমিকাই রাখছে না।

অবশ্য এই বিভক্তিকরণের মূল কারণ বেশ কিছু প্রবীন নেতাদের মুখে শোনা গেছে। তাঁদের মতে, সংগঠনের হর্তাকর্তা মানে সভাপতি, সেক্রেটারীসহ পদ পদবী সম্বলিত নেতাদের লোভের কারণেই বিভিন্ন সংগঠনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং সেখান থেকে ভেঙ্গে গিয়ে তারা নতুন অনেক সংগঠনের জন্ম দেয়।

তিন.
লেবাননের ছোট্ট একটি দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় যেখানে বাংলাদেশীদের বসবাস বেশি, সেখানে বিভিন্ন নামধারী সামাজিক সংগঠনের প্রতিযোগীতা যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। শুধুমাত্র লেবাননের রাজধানী বৈরুতেই নানা নামে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সব মিলিয়ে ঠিক কতটি আছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা মুশকিল। তবে বৈরুতের দু’একটি সংগঠন তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশী কমিউনিটির উন্নয়নে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ঠিক তেমনিভাবেই এতসব নতুন সংগঠনের মধ্যে হাতে গোনা দু’একটি সংগঠন সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশী কমিউনিটির উন্নয়নে তাদের সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছে।

একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়তে বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন-পালন, নানা প্রতিকূলতা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ও একটি সুন্দর ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশী কমিউনিটি গড়ে তুলতে একটি সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই পৃথিবীর যেসব দেশে বাংলাদেশী প্রবাসীদের বসবাস, সেখানেই গড়ে উঠুক সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা সেচ্ছাসেবী সংগঠন। তবে সেটা নিজের স্বার্থে বা নাম ফোটানোর উদ্দেশ্যে না হয়ে হোক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সামাজিক উন্নয়ন ও সকলের কল্যাণের লক্ষে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাইমসকে বলেন, আমাদের দূতাবাসের জানামতে এই মূহুর্তে লেবাননে দু’একটি সংগঠন ছাড়া আর কোন সামাজিক সংগঠন নেই। আর এই দু’একটি সংগঠন থাকলেও তারা চাঁদাবাজি করেনা বলে আমাদের জানান।

তিনি আরো বলেন, ২০১৫ সালে দূতাবাসে যোগদান করার পর যখন দেখলাম প্রায় ডজন খানেক সামাজিক সংগঠন রয়েছে ধীরে ধীরে আমরা এগুলোর খোঁজ নিতে শুরু করি। একপর্যায়ে যখন দেখলাম তারা কর্মীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে চাঁদাবাজি করছে এবং জনগণকে সাহায্যের নামে তাদেরকে শোষণ করছে। তখন এ বিষয়ে দু’একটি সংগঠনের কাছে জানতে চেয়েছি তারা কোথায় এবং কিভাবে চাঁদার টাকা ব্যায় করছে? জবাবে তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।

এরপর প্রত্যেকটি সামাজিক সংগঠনকে ছয়মাস অন্তর অন্তর বছরে দুই বার দূতাবাসের যেকোন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মীদের কাছে চাঁদার টাকার হিসেব দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ এর বরখেলাপ করলে যেকোন সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও কঠোর হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি যে প্রায় অনেকগুলো সংগঠনই নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে এই দু’একটি সংগঠন ছাড়া নতুন আরো সংগঠন আছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে সামাজিক সংগঠনের নামে যদি চাঁদাবাজির কোন অভিযোগ দূতাবাসে আসে আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা নিবো।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

September 2018
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
আরও পড়ুন