২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

EN

জলে চীন, ডাঙায় রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র কই?

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ৩:৫৭ অপরাহ্ণ , ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 6 years আগে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী—এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল বিশ্ব। এখন আর তা নেই। ভেঙে গেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। নতুন রাশিয়ায় সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তির হম্বিতম্বি বেশি। একই অবস্থা চীনে। সমাজতন্ত্রের অনুসারী দাবি করলেও চীনে পুঁজির দাপট চলছে ভালোই। এবার একটি ক্ষেত্রে এক মঞ্চে দুই দেশ। যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে রাশিয়া-চীন। এতে বৈশ্বিক দৃশ্যপটে ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিত্যনতুন কার্যকলাপে জেরবার যুক্তরাষ্ট্র। তিনি আজ হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, কাল নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন, পরশু আবার সুর নরম করছেন। ট্রাম্পের উদ্ভট কথায় ভরসা করার মতো ব্যক্তি খোদ মার্কিন মুলুকে পাওয়া দুষ্কর। তাঁর সম্পর্কে একটি শব্দ বেশ জুতসই, ‘আনপ্রেডিক্টেবল’! বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সুযোগেই সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের রিলে রেসে এগিয়ে গেছে রাশিয়া ও চীন। এই দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক সুবিধের নয় যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ একই—প্রতিযোগিতা ও আঞ্চলিক স্বার্থ।

নিন্দুকেরা বলছেন, বিশ্ব মোড়লের মুকুট যুক্তরাষ্ট্রের হাতছাড়া হলো বলে! এত দিন মনে করা হচ্ছিল, চীন ও রাশিয়া হয়তো মুকুট অধিকারের লড়াইয়ে একে-অন্যের মুখোমুখি হবে। এই দুটি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতভিন্নতা সেই আভাস দিচ্ছিল। কিন্তু হুট করেই দুই দেশের এক অভাবিত সিদ্ধান্তে গণেশ উল্টে গেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়া জানিয়েছে, এই সেপ্টেম্বরে বিশাল এক সামরিক মহড়া করবে দেশটি। আর তাতে যোগ দেবে চীন।

মস্কোর রেড স্কয়ারে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়া। ছবিটি ২০১৫ সালে তোলা। ছবি: এএফপি মস্কোর রেড স্কয়ারে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়া। ছবিটি ২০১৫ সালে তোলা। ছবি: এএফপি

রুশ সংবাদমাধ্যম দ্য মস্কো টাইমস বলছে, গত তিন দশকের মধ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া হবে এটি। নাম দেওয়া হয়েছে ভস্তক-২০১৮। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া সর্বপ্রথম এভাবে বিশাল মহড়া করে সামরিক শক্তির বড়াই করছে। প্রায় তিন লাখ রুশ সেনা অংশ নেবেন এতে। হবে নিত্যনতুন সামরিক প্রযুক্তির পরীক্ষা। আকাশে উড়বে এক হাজার রুশ সামরিক উড়োজাহাজ। থাকবে দুটো নেভাল ফ্লিটও। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

অন্যদিকে এই মহড়ায় বেইজিংয়ের অংশগ্রহণ সংখ্যাগত দিক থেকে তুলনামূলকভাবে কম। বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদনে প্রকাশ, ৩ হাজার ২০০ সেনা ও ৩০টি হেলিকপ্টার পাঠাবে চীন। সঙ্গে থাকবে প্রায় ৯০০টি সামরিক যন্ত্রপাতি। তবে ঠিক কী ধরনের যন্ত্রপাতি, তা স্পষ্ট করেনি চীনারা। সামরিক বিষয়ে এই গোপনীয়তা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।

চীন-রাশিয়ার এমন যৌথ সামরিক মহড়ায় এরই মধ্যে নড়েচড়ে বসেছে পশ্চিমা দেশগুলো। ন্যাটো বলছে, উরাল পার্বত্য এলাকায় অনুষ্ঠেয় এই সামরিক মহড়া সম্পর্কে ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বকে জানাতে বাধ্য নয় রাশিয়া। তবে এটি হওয়া উচিত স্বচ্ছ ও কাঙ্ক্ষিত আচরণ মেনে। ইউরোপের দেশগুলো বা কোনো নিরাপত্তা সংস্থাকে মহড়ায় আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। ন্যাটোর মুখপাত্র ডিলান হোয়াইটের মতে, এই পরিকল্পিত মহড়ার মাধ্যমে আরও আত্মবিশ্বাসীরূপে আবির্ভূত হবে মস্কো। দেশটি কেন প্রতিরক্ষা বাজেট ও সমরাস্ত্র উন্নয়নে দেদার খরচ করছে, সেটির যথোপযুক্ত প্রমাণ দেবে এই মহড়া।

আবার চীন এই মহড়ায় অংশ নেওয়ায় কপালের ভাঁজ বেড়েছে জাপানের। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মহড়া চলাকালে রাশিয়া সফর করার কথা জানিয়েছেন। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চীন-রাশিয়ার সামরিক সম্পর্কের ওঠাপড়া পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

চীন ও রাশিয়ার সেনাদের যৌথ মহড়ার দৃশ্য। ২০১৬ সালে চীনে এই মহড়া হয়েছিল। ছবি: রয়টার্স চীন ও রাশিয়ার সেনাদের যৌথ মহড়ার দৃশ্য। ২০১৬ সালে চীনে এই মহড়া হয়েছিল। ছবি: রয়টার্স

‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকটে আছে মস্কো। তবে রাশিয়া স্পষ্টতই জানিয়েছে, বড় ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবেই এই মহড়ার আয়োজন। যুদ্ধ সন্নিকটে ধরে নিয়েই দুই দেশ যৌথ পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, এ কারণেই সামরিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পথে হাঁটাই রুশ সরকারের একমাত্র বিকল্প।

কেন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে রাশিয়া-চীন?
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের লাল পতাকা ছড়িয়ে দিয়েছিল পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে। সোভিয়েতে ভাঙনের কারণে ওই দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণও ধরে রাখা যায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার মূল পরিকল্পনা পূর্ব দিকের এলাকা ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এ জন্য স্থলবাহিনীকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। অন্যদিকে চীন এগোচ্ছে সমুদ্রপথে। কারণ দক্ষিণ চীন সাগর ও আশপাশের এলাকাতে প্রভাব বাড়াতে এর বিকল্প নেই।

রয়টার্সের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, রাশিয়ার আয়োজনে এই যৌথ মহড়ার নাম রাখা হয়েছে ভস্তক। এই রুশ শব্দটির বাংলা তরজমা হলো ‘পূর্ব দিক’। প্রকৃত উদ্দেশ্যের একেবারে আক্ষরিক নামই দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এর সঙ্গে আঞ্চলিক দেশগুলোকে দাবিয়ে রাখার বিষয়টিও যুক্ত। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের পর জর্জিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে তিক্ততা ভুলে যায়নি ক্রেমলিন। ওই সময় স্থলবাহিনীর জোরেই যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে পেরেছিল রাশিয়া। তাই এবারের বিশাল মহড়ায় তিন লাখ সেনার অংশগ্রহণে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সমুদ্রে চীন-রাশিয়ার যৌথ মহড়ার দৃশ্য। ২০১৬ সালে চীনে হয়েছিল এই মহড়া। ছবি: রয়টার্স সমুদ্রে চীন-রাশিয়ার যৌথ মহড়ার দৃশ্য। ২০১৬ সালে চীনে হয়েছিল এই মহড়া। ছবি: রয়টার্স

আবার দক্ষিণ চীন সাগর বা তাইওয়ানে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন চীনের। এ জন্যই দেশটির রণনীতি অনেকাংশে সাগরমুখী। দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের সামরিকায়ন শুরু করেছেন। কারণ, ওই এলাকায় প্রভাব ধরে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত অঞ্চলে চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বাধা তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর নৌবাহিনী। তাই আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার জন্য সামরিক বিকল্পকে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। রাশিয়ার সঙ্গে মহড়ায় অংশ নিয়ে তারই জানান দিচ্ছে দেশটি।

‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ১৯৭০-এর দশকে ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে দীর্ঘদিন যুদ্ধের সরাসরি অভিজ্ঞতা নেই চীনের। রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ মহড়াটি হবে চীনের জন্য শিক্ষামূলক। কেননা রুশদের আছে সিরিয়া-যুদ্ধের টাটকা অভিজ্ঞতা।

সম্প্রতি চীনের পুলিশ কর্মকর্তা ও রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরাও যৌথ মহড়ায় অংশ নেন। ছবি: রয়টার্স সম্প্রতি চীনের পুলিশ কর্মকর্তা ও রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরাও যৌথ মহড়ায় অংশ নেন। ছবি: রয়টার্স

বেইজিংভিত্তিক সামরিক পর্যবেক্ষক ঝৌ চেনমিং বলছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট এই মুহূর্তে নানা দিক থেকে কূটনৈতিক চাপে আছেন। এই মহড়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক শক্তি দেখাতে চাইছেন তিনি। এই যৌথ মহড়ায় অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি এক ধরনের রাজনৈতিক সমর্থন জানিয়েছে চীন। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসন চীন-রাশিয়াকে কৌশলগত শত্রুর তালিকাতেই রেখেছে।

চীনের সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করতে রাশিয়া অনন্যোপায় বলে মনে করেন ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলসের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক জোনাথন হোলস্ল্যাগ। তিনি বলেন, পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলাতে চীনা ইউয়ান দরকার পুতিনের। তাই সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে হাত মেলাতে বাধ্য হচ্ছেন পুতিন-চিন পিং।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

September 2018
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
আরও পড়ুন