চিশতীর সম্পদ জব্দ করবে দুদক ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ৩:২২ পূর্বাহ্ণ , ২৯ আগস্ট ২০১৮, বুধবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 years আগে
অর্থনীতি ডেস্ক : ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর (বাবুল চিশতী) নামে-বেনামে থাকা প্রায় পাঁচশ’ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ লক্ষ্যে কমিশন থেকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে সম্প্রতি আবেদন পেশ করা হয়েছে। আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর তার নামে-বেনামের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ জব্দ করা হবে। দুদক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানে ব্যাংকটিতে ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতি, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে আসে। ব্যাংকের নথিপত্রে দেখা যায়, চিশতী লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এই মামলায় তিনি বর্তমানে জেলে আছেন।
দুদক সূত্র জানায়, চিশতীর সম্পদের বৈধ উৎসের তথ্য পাওয়া যায়নি। চিশতীকে জেল থেকে জামিনে মুক্ত করার অর্থ জোগাতে এরই মধ্যে কিছু সম্পদ বিক্রিও করা হয়েছে। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পদ জব্দের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে জব্দের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন পেশ করা হয়।
জানা গেছে, আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর সম্পদ বেচাকেনা বন্ধে আদালতের আদেশের কপি ও সম্পদের তালিকা ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে পেশ করা হবে। পরে ওইসব কপি অঞ্চলভিত্তিক সাব রেজিস্ট্রারদের কাছে পাঠানো হবে। একই সঙ্গে ওইসব সম্পদের শেয়ার হস্তান্তর বন্ধে আদালতের আদেশের কপি ও সম্পদের তালিকা রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে পেশ করা হবে। একটি বিশেষ টিম চিশতীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে চিশতীর নিজের, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে প্রায় পাচশ’ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও জামালপুরের বকশীগঞ্জে নিজ এলাকায় রয়েছে ওইসব সম্পদ।
ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত ওইসব সম্পদ কৌশলে নিজের, পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজনদের নামে রেখেছেন। ব্যাংকে দায়িত্ব পালনকালে তার বৈধ আয় ছিল সামান্য। ওই সময়ে ব্যাংক ও গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।
চিশতী নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শেয়ার, ব্যাংকে জমানো টাকাসহ নানা ধরনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ।
সূত্র জানায়, জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার উত্থানুপাড়া গ্রামের সাধারণ পরিবারের সদস্য ছিলেন চিশতী। পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাতে বগুড়ার গ্যারিসন সিনেমা হলের সহকারী হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে। প্রতারণা, জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ রোজগার শুরু হয় সেখান থেকেই। কালোবাজারে সিনেমার টিকিট বিক্রিতে ছিল তার হাত। সিনেমা হলের আয় থেকেও টাকা মেরে দেওয়ার অভ্যাস ছিল তার। এ ছাড়া প্রতারণার ফাঁদ পেতে বিভিন্নজনের কাছ থেকে হাতিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হন ২০১৩ সালে। এরপর থেকে অবৈধ উপায়ে দু’হাতে টাকা কামাতে থাকেন তিনি। এভাবেই তিনি পাঁচশ’ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে রেখেছেন সম্পদ। তারা ওইসব সম্পদ পরিচালনা ও ভোগ করলেও ওইসবের ওপর শতভাগ কর্তৃত্ব রয়েছে চিশতীর।
গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাতের অভিযোগে চিশতীসহ ছয়জনকে আসামি করে দুদক ঢাকার গুলশান থানায় মামলা করে গত ১০ এপ্রিল। শিগগির এটির চার্জশিট আদালতে পেশ করা হবে।
জানা গেছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে বিতর্কিত এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তায় স্থানীয় জনগণের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেন তিনি। জ্বালাও-পোড়াও ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডেও জড়িত ছিলেন।
ঢাকায় নামে-বেনামে সম্পদ :দুদকের তথ্যমতে, ফারমার্স ব্যাংকে ৪০ কোটি টাকার উদ্যোক্তা পরিচালকের শেয়ার, রাশেদ এন্টারপ্রাইজ নামীয় দুটি জাহাজ, রাজধানীর মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের ৩০ নম্বর রোডের ৪১৯ নম্বর বাড়িতে বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার নিকুঞ্জের ২/এ নম্বর রোডের ১৮ নম্বর প্লটে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, তেজগাঁওয়ের এলেনবাড়ীতে ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর নামে ছয়তলা বাড়ি, শ্যালক মোস্তফা কামালের নামে ঢাকার গুলশান ও বনশ্রীতে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, মিরপুর-১২ নম্বরে বকশীগঞ্জ টাওয়ার নামীয় সাততলা বাড়ি, আত্মীয় গোলাম রসুল সেতুর নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফারাহ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আত্মীয় নিয়ামুল হক পলিনের নামে ইভা এন্টারপ্রাইজ ও চিশতীর ভায়রার স্ত্রী সোনিয়া আক্তার রনির নামে বনশ্রীতে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
ময়মনসিংহে সম্পদ :ময়মনসিংহ সদরে ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের ওপরতলায় চিশতীর নামে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, জেলা সদরে ফারমার্স ব্যাংক ভবনে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, কাছিঝুলি এলাকায় ‘রোজী চিশতী ভিলা’ নামে নয়তলা আবাসিক ভবন, শহরের পুলিশ লাইনের পাশে বাবুল চিশতী ও তার শ্যালক মোস্তফা কামালের নামে ৫০ শতাংশ জমি, শ্যালক মোস্তফা কামালের নামে ৩০ শতাংশ জমি, দুটি ট্রাক, তিনটি প্রাইভেট কার, জেলার শম্ভুগঞ্জ বাজার সংলগ্ন জায়গায় এক একর ৫০ শতাংশ জমি রয়েছে।
নিজ এলাকা বকশীগঞ্জে সম্পদ :বকশীগঞ্জ উপজেলার লাউচাপড়া পিকনিক স্পট সংলগ্ন ১৫ একর জমির ওপর বনফুল ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স, কালামপুরের মির্ধাপাড়া রোডে দুই একর জমির ওপর ‘রিমি ভিলা’ নির্মাণ, এক একর জমিতে রাশেদ রিমি ফিলিং স্টেশন স্থাপন, উপজেলার উত্তর প্রাইমারি স্কুলের পাশে নির্মাণাধীন দশতলা ভবন, উত্তর পার্টহাটীতে নিজ মালিকানাধীন ছয়তলাবিশিষ্ট ফারমার্স ব্যাংক ভবন, চর কাউনিয়াতে পঞ্চাশ একর জমিতে বকশীগঞ্জ জুট মিলস, ফিউশন সুজ, আরসিএল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি স্থাপন, শ্যালক মোস্তফা কামালের নামে এক একর জমিতে দশ কোটি টাকা ব্যয়ে মেসার্স ফারিব অটো রাইস মিলস স্থাপন, মোস্তফা কামালের নামে বকশীগঞ্জ গোয়ালগাঁও ইটভাটা, কৃষি ব্যাংকের বাট্টাজোড় নতুন বাজার শাখায় কয়েক কোটি টাকার এলডিআর, জনতা ব্যাংকের ধানুয়া কামালপুর শাখায় আত্মীয়স্বজনের নামে কয়েক কোটি টাকার এলডিআর, গ্রামীণ ব্যাংকের ধানুয়া কামালপুর শাখার হিসাবে কয়েক কোটি টাকা জমা ও দত্তের চরে পাঁচ একর জমিতে বাড়ি নির্মাণ, নিজ এলাকায় নামে-বেনামে প্রচুর জমি রয়েছে।
বিদেশে সম্পদ : চিশতীর নামে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে বাসা-বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। দুদকের ওই মামলা রুজুর দিনেই চিশতীসহ চার আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত অন্য তিনজন হলেন- বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ব্যাংকের ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান খান ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জিয়া উদ্দিন আহমেদ। চারজনই বর্তমানে জেলে আছেন। অন্য দু’জন আসামি হলেন- চিশতীর স্ত্রী রুজী চিশতী ও ব্যাংকের এসইভিপি ও গুলশান শাখার সাবেক ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন। এরই মধ্যে রুজী চিশতী হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন নিয়েছেন। চিশতীও জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
আপনার মন্তব্য লিখুন