ঈদে ৪৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ৩:৩০ পূর্বাহ্ণ , ২৭ আগস্ট ২০১৮, সোমবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 years আগে
অর্থনীতি প্রতিনিধি : ঈদ উৎসব ঘিরে প্রতি বছর বাড়ছে বাণিজ্য। উৎসবকেন্দ্রিক বাণিজ্যের মধ্যে ঈদে লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি। এবার ঈদুল আজহায় ভোক্তা পর্যায়ে অন্তত ৪৫ হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে কোরবানির পশু কেনাবেচায়। এর পরে রয়েছে মসলার বাণিজ্য। ঈদ কেন্দ্র করে পরিবহন খাতে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। ফ্রিজ, ফার্নিচার, গাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন পণ্য কেনাবেচা হয়েছে। ঈদে পর্যটন ঘিরেও বেশ বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে।
মাংস ব্যবসায়ী এবং চামড়া খাতের বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, এবার নির্বাচনের বছর হওয়ায় গতবারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পশু বেশি কোরবানি হয়েছে। প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ পশু কেনাবেচা হয়। এর মধ্যে গরু, মহিষ ও উট প্রায় ৬০ লাখ এবং ৬৫ লাখ ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কোরবানি হয়েছে। সে হিসাবে প্রতিটি গরু, মহিষ ও উটের গড় দর ৫০ হাজার টাকা করে হলে ৩০ হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হয়েছে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার গড় দর ৮ হাজার টাকা হলে এসব পশু কেনাবেচা হয়েছে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে এবার প্রায় ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার পশু কেনাবেচা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এবার ঈদে কোরবানিযোগ্য দেশি পশু ছিল প্রায় এক কোটি ১৬ লাখ। তার মধ্যে গরু ও মহিষ ৪৫ লাখ, ছাগল ও ভেড়া ৭১ লাখ এবং উট ও দুম্বাসহ অন্যান্য প্রাণী ৩১ হাজার। ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারি হিসাবের বাইরে কিছু পশু এসেছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে। যদিও এবার ঈদে দেশি কিছু পশু অবিক্রীত ছিল।
চামড়া ব্যবসায়ী সংগঠন হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবমতে, ২০১৭ সালে এক কোটি ৫ লাখ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারিগুলো। প্রতি বছর কোরবানির পশুর সংখ্যা ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে বাড়ে।
এবার ঈদ নির্বাচনের বছর হওয়ায় কোরবানি বেশি হয়েছে। সে কারণে এবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চামড়া বেশি হবে। এবার এক কোটি ২০ লাখ চামড়া সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে ট্যানারিগুলোর। ট্যানারি মালিকরা নির্ধারিত দরে চামড়া কিনলে প্রতিটি গরুর চামড়ার গড় দর হবে এক হাজার টাকা আর ছাগলের চামড়ার দর হবে ৫০ টাকা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, এবার ঈদে পশুর ও পশুর চামড়ার লেনদেনের পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ঈদুল আজহার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হয় পশু ও চামড়া কেনাবেচায়। ট্যানারি মালিকরা অপেক্ষায় থাকেন ভালো মানের চামড়া কিনতে। ঈদে কোরবানি হওয়া পশুর চামড়া বেশিরভাগই রফতানি হয়। তিনি বলেন, বছরে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত হয় ট্যানারিগুলোতে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ চামড়া আসে ঈদুল আজহায়। এবার নির্বাচনের বছরে বেশি পশু জবাই হওয়ায় চামড়ার পরিমাণ আরও বাড়বে। এবার প্রায় ১২ কোটি বর্গফুট বড় চামড়া আসবে। প্রতিটি চামড়া গড়ে ২০ বর্গফুট ধরলে এবার গরু ও মহিষের ৬০ লাখ চামড়া পাওয়া যাবে। তিন কোটি বর্গফুট ছোট চামড়া আসতে পারে। এই চামড়া গড়ে ৫ বর্গফুট হলে ৬০ লাখ ছাগল ও ভেড়ার চামড়া মিলবে। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০ থেকে ৬৫০ কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হবে।
এবার ঈদে রান্নাসামগ্রী ভোজ্যতেল ও মসলাসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এই ঈদে আড়াই লাখ টন ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়।
প্রতিলিটার ভোজ্যতেলের গড় দর ১০০ টাকা হিসাবে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভোজ্যতেল কেনাবেচা বেশি হয়। ঈদের বাড়তি চাহিদা দুই লাখ টন পেঁয়াজের প্রয়োজন হয়। গড় দর ৪০ টাকা ধরলে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বিক্রি হয়। রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গরম মসলা এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরাসহ অন্যান্য মসলা বিক্রি হয়েছে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার মসলা কেনাবেচা হয়েছে।
পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী এনায়েত উল্লাহ বলেন, এবার ঈদবাজারে মসলার ১০ শতাংশ বাড়তি কেনাবেচা হয়েছে। তবে পুরান ঢাকার পাইকারি বাজারে কেনাবেচা তেমন বাড়েনি। সারাদেশে মসলার বাজারে কেনাবেচা অনেক ভালো ছিল।
ঈদ বিনোদন ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠেছে পর্যটন বাণিজ্য। ভ্রমণপিপাসুদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। পর্যটনের আকর্ষণীয় কেন্দ্র ঘিরে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেলগুলোতে রয়েছে ভিড়। এফবিসিসিআই এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ঈদে পর্যটন মৌসুম ঘিরে হোটেল-মোটেল, এয়ারলাইন্সসহ বিভিন্ন পরিবহনে ভ্রমণ ও বিনোদনে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ঈদে পরিবহন ভাড়ায় লেনদেন হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। ঈদুল আজহা এলেই বেড়ে যায় ফ্রিজের চাহিদা। এ সময় নানা অফারে কেনাবেচা হয় ফ্রিজ, ফার্নিচার, গাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ নানা পণ্যের। এবার ঈদে এর পরিমাণও আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কোরবানির পশুর মাংস কাটায় ব্যবহূত দা, বঁটি, ছুরি, চাপাতিসহ নানা সামগ্রীর বিক্রি বেড়ে যায় বহুগুণ। এগুলো বিক্রির পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উৎসবকেন্দ্রিক বাজার বড় হচ্ছে। এর তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর প্রকাশ করা উচিত। সেবা, পণ্য, পরিবহন ও পর্যটন সবকিছুই বেড়ে যায়। এর সঠিক হিসাব থাকা উচিত। কারণ এসব খাতে যারা বিনিয়োগ করেন তারা ঝুঁকি নিয়ে করছেন। সঠিক তথ্য প্রকাশ পেলে তারা সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবেন। তিনি বলেন, মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। এখন ঈদবাজার শুধু কাপড় ও জুতা কেনাকাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফার্নিচার, গাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যয় বাড়ছে। তাছাড়া আগে বেশিরভাগ মানুষ ভাগে কোরবানি দিলেও এখন এককভাবেই দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ঈদ-বাণিজ্যের এসব সেবা ও পণ্য স্থানীয় উৎপাদনকেন্দ্রিক হওয়া উচিত। বিশেষ করে পশু উৎপাদন বাড়াতে নজর দেওয়া প্রয়োজন। অনেক পণ্য এখন ঈদবাজারে বিক্রি করতে আমদানি হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এ বিষয় নজর দিতে হবে। বিশেষ করে ব্যাগেজ রুলে যে পণ্য আসে, তা সীমিত করে দেওয়া উচিত। ঈদের কেনাকাটার জন্য বড় অঙ্ক দেশের বাইরে যায়। এটি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
আপনার মন্তব্য লিখুন