লেবাননে নারী পাচারকারীকে ধরিয়ে দিল প্রবাসী বাংলাদেশীরা!
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ১১:০৯ অপরাহ্ণ , ২০ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 years আগে
লেবানন থেকে জহির রায়হান : লেবাননের জুনি আধুনিস এলাকা থেকে নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য শুকুর আলী(৩৮) নামক এক বাংলাদেশীকে আটক করে লেবাননের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করেছে স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশীরা। পাচারকারী চক্রের সদস্য শুকুর আলীর বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। গত শনিবার (১৭ মার্চ) তাকে আটক করা হয়।
সরেজমিন অনুসন্ধানে ও স্থানীয় বাংলাদেশি প্রবাসীদের সূত্রে জানা যায়, পাচারকারী শুকুর আলী লেবানন থেকে পাশ্চাত্যের গ্রীসে পাঠানোর কথা বলে ফুসলিয়ে হ্যাপি আক্তার(২৪) ও শাহনাজ আক্তার বেবি(৩৫) নামের দুই বাংলাদেশি নারীকে পাচার করে দেয়। পাচার হয়ে হয়ে যাওয়া হ্যাপি মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার ধামালিয়া গ্রামের ফরিদা বেগমের মেয়ে এবং অপরজন শাহনাজ আক্তার বেবি ঢাকা গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর উপজেলার মধ্য ভুরুলিয়া গ্রামের মোঃ মনির হোসেনের স্ত্রী। তারা উভয়ই গৃহপরিচারিকার কাজে লেবাননে এসেছিলেন।
স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশীদের ধারণা এদেরকে বিক্রি করা হয়েছে। এদিকে দুই মেয়ের খোঁজে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এখন পাগল প্রায়। কথায় আছে “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”। দুই নারীকে পাচার করার পর যখন আবারও পাচারের আশায় এদিক ওদিক লোক খোঁজাখুঁজি শুরু করে। স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশীদের মনে তখন সন্ধেহ জাগে এবং সন্ধেহের তীর শুকুর আলীর দিকেই।
গত শনিবার (১৭ মার্চ) সকালবেলা আরো দুই মেয়েকে গ্রীসে পাঠাবে মোবাইল ফোনে শুকুর আলীকে এমন কথা জানালে তাৎক্ষুনিক রাজি হয়ে যায়। ভুক্তভোগীর পরিবার ও স্থানীয় সাধারণ প্রবাসীদের নাটকীয়ভাবে পাতানো ফাঁদে শুকুর আলী এসে ধরা দেয়। তারপর স্থানীয় বাংলাদেশি সাইফুল ইসলাম এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ও পুনর্বাসন সোসাইটি লেবানন যুব কমান্ডের সভাপতি সৈয়দ আমির হোসেন তাকে আটক করেন। আটকের পর ব্যাপক জিজ্ঞেসবাদ ও কিছু উত্তমমধ্যম দেওয়ার পর অকপটে সবকিছু স্বীকার করে বলে হ্যাপি আক্তার ও শাহনাজ আক্তার বেবি নামক দুই নারীকে ২ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে শুকুর আলী তাদেরকে পাচার করেছে। বর্তমানে ঐ দুই নারী সিরিয়ার কোন এলাকায় আছে তা সঠিকভাবে বলতে পারছেনা। এমনকি সিরিয়ায় অবস্থানরত পাচারকারী অপর সদস্যদের সাথে মোবাইল ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। পরে লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব এর হস্তক্ষেপে পাচারকারী শুকুর আলীকে লেবানন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
নিখোঁজ হ্যাপির মা ভুক্তভোগী ফরিদা বেগম ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাইমসকে বলেন, তার মেয়ে হ্যাপি প্রতিদিনের ন্যায় কাজে যায় এবং ঠিক সময়মত বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেও রাত অবদি বাসায় না ফেরাতে ভীষণরকম চিন্তায় পরে যাই। সারারাত না ঘুমিয়ে চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকি এবং আশেপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। কিন্তু সবার একই কথা আমার মেয়ে হ্যাপিকে সারাদিন কেউ কোথাও দেখেনি। পরে লোকমুখে শুনতে পাই শুকুর আলী নামে এক ব্যক্তি অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে গ্রীসে লোক পাঠায়। একথা শুনে কেনো যেনো আমার মন বলছে আমার মেয়ে হ্যাপি কি গ্রীসে চলে গেলো নাকি? তখন সাইফুল ইসলাম ও সৈয়দ আমীর হোসেনের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। তখন তারা পাচারকারী শুকুর আলীকে কল দেওয়ার জন্য আমায় পরামর্শ দিলেন।
পরে তাদের পরামর্শমত পাচারকারী শুকুর আলীকে কল দিয়ে বলি, দুজন মেয়ে গ্রীসে যেতে ইচ্ছুক আপনি কি তাদের পাঠাতে পারবেন? জবাবে শুকুর আলী বললো অবশ্যই পাঠাতে পারবো, কোথায় আসতে হবে বলেন? তারপর আমার বাসার ঠিকানা দিলে ঘন্টা খানিকের মধ্যে বাসায় চলে আসে। তখন সাইফুল ইসলাম ও সৈয়দ আমীর হোসেন এসে শুকুর আলীকে আটক করে। তারপর জানতে পারি আমার মেয়েসহ শাহনাজ আক্তার বেবি নামক আরেক মেয়েকে সে পাচার করে দিয়েছে। এই কথাগুলো বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
কান্না জড়িত কণ্ঠে পাচার হয়ে যাওয়া হ্যাপির মা একটি কথাই বলেন, আমি থানা-পুলিশ, টাকা-পয়সা কিছুই বুঝিনা। আমি শুধু চাই আমার মেয়ে আমার কোলে ফিরে আসুক। এজন্য তিনি লেবাননে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের সুদৃষ্টি কামনা করেন এবং তার মেয়ের জীবন ভিক্ষা চান।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ও পুনর্বাসন সোসাইটি লেবানন যুব কমান্ডের সভাপতি সৈয়দ আমির হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাইমসকে বলেন, অত্যন্ত সুকৌশলে নারীর প্রলোভন দেখিয়ে জুনির আধুনিস এলাকায় পাচারকারী শুকুর আলীকে আনা হয়েছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে সব তথ্য বেরিয়ে আসে। বিষয়টি রাষ্ট্রদূত মহোদয়কে অবগত করলে তিঁনি তাঁর সহকারী খালেদের মাধ্যমে লেবাননের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেন।
পাচারকারী শুকুর আলী সমাজের একজন নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত ব্যক্তি। সামান্যকিছু টাকার জন্য যারা নিজের দেশ এবং দেশের মেয়েদের বিক্রি করে দেয়। তাদেরকে বাঁচিয়ে না রেখে আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা এখন সময়ের দাবী। পক্ষান্তরে পাচার হয়ে সিরিয়ায় থাকা দুই নারীকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকারের নিকট জোর দাবী জানিয়েছেন স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাইমসকে বলেন, যারা প্রবাসীদেরকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে বা ক্ষতি করছে তাদের ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত কঠোর। তারা যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আর আমরা দূতাবাস থেকে সরকারের সেই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করছি।
পাচার হয়ে যাওয়া দুটি মেয়ে সিরিয়া থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দূতাবাস কোন উদ্যোগ নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই নারীকে কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এ ব্যাপারে আমরা লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটির সাথে কথা বলেছি। ইতিমধ্যেই তারা তাদের নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে তথ্য বের করার সন্ধানে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছে। একইসাথে আমাদের একজন অনারেবল কনস্যুলার আছেন সিরিয়ায়। আমরা তাঁর কাছেও দুই নারীর নাম ঠিকানা দিয়ে সহযোগীতা চাইবো। তাদেরকে উদ্ধারের জন্য আমাদের সব রকমের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের নারী পাচারকারীকে ধরিয়ে দিয়ে জনগণ চমৎকার একটি ভূমিকা পালন করেছে। আমরা আশা করবো ভবিষ্যতেও এই ধরনের ভূমিকা তাদের অব্যাহত থাকবে। দেশের স্বার্থে এবং দেশের মানুষের স্বার্থে।
আপনার মন্তব্য লিখুন